সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক॥ শিক্ষার্থীবিহীন রাজাপুর উপজেলার পশ্চিম বাদুরতলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছলচাতুরী করে সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থ ও বাড়িতে বসে ভাতা ভোগ করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা। মাসে স্কুলে যান দু’একদিন তাও নামেমাত্র। বাকিটা সময় কাটান তাদের খেয়াল খুশির পেশায়।
এলাকার ভূমিদস্যু খ্যাত আবু বক্কর হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি অগ্রগামি ভুমিকায় ম্যানেজ করে সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের সাথে গোপন সক্ষতা গড়ে সরকারের অর্থ লুট পাট করে চলেছে। ৬ জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও স্কুলে গিয়ে পাওয়া গেলো না একজনকেও। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সংখ্যাও শূণ্য। গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে কয়েকজন উপস্থিত হয়ে পতাকা উত্তোলন করে এবং ধুলোয় পুর্ন থাকা চেয়ার টেবিলে ঝারপোছ শুরু করে দেয়। সকাল ৯ টার ক্লাস শুরু হয় দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে যদিও ছিলনা কোন শিক্ষার্থী। মাসিক হাজিরা খাতায় একসাথেই পুরো মাসের সাক্ষর দিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলছে তারা।
স্কুলের উপবৃত্তির টাকা,সরকারি পাঠ্যবই বিক্রি,বিদ্যালয় সংস্কারের নামে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা লোপাট করে একরকম সরকারি তদারককারী দপ্তরের অগোচরে প্রতারণা করে এযাবত প্রায় কোটি টাকা লুটপাট করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবু বক্কর হাওলাদার নামের এক জুনিয়র শিক্ষকের নেতৃত্বে ৩৩ বছর স্কুল পরিচালনার নামে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজাপুর উপজেলা শিক্ষা দপ্তরের অসাধু কতিপয় কর্মকর্তাদের সাথে সক্ষতা গড়ে বিনা পাঠদানেই সরকারি ভাতাসহ বরাদ্দকৃত অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার পশ্চিম বাদুরতলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মুখ্য ভুমিকায় থাকা শিক্ষক আবু বক্করসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষার্থী বিহীন বিদ্যালয়টি বহু বছর যাবৎ সরকারি সকল বরাদ্দসহ প্রতিমাসের ভাতা ভোগ করে আসলেও এখন পর্যন্ত কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৮৬ সালে স্থাপিত বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার পশ্চিম বাদুরতলা নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির ভবন ও ক্লাশ রুমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বেঞ্চ, টেবিল, ব্লাক বোর্ড থাকলেও নেই শিক্ষক, শিক্ষিকা এমনকি একজন শিক্ষার্থীও। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রধান শিক্ষক সরকারি বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা ৩৩ বছর একই স্কুলে কর্মরত থাকাটা যেকোন চাকরি বিধির পরিপন্থি। তবে, সরকারি ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এই বিধি সহজতর করা হয়।
সেক্ষেত্রে ৩৩ বছর চাকরি করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। যা কেবল প্রধান শিক্ষক আখতারুজ্জামান বাচ্চুর সাথে যোগসাজসের কারনেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। বেশ কয়েকদিন সরেজমিনে অনুসন্ধান করলে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পুর্ন বন্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চত হওয়া গেছে। স্কুলটির শিক্ষকদের সাথে কথা বললে সরকারের সাথে প্রতারণা করার বিষয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রমান বেরিয়ে আসে। ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার পশ্চিম বাদুরতলা নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গিয়ে ধর্মীয় শিক্ষক আব্দুল বারির নিকট জানতে চাইলে মহুর্তের মধ্যে আরো কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা উপস্থিত হয় গনমাধ্যম কর্মীদের সামনে। বৈরী আবহাওয়ার অযুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শূন্য বলে জানালেও হাজিরা খাতায় প্রতিদিনের উপস্থিতির বিষয় স্পষ্ট দেখা যায়, এমনকি ওই দিনের হাজিরা খাতায় সবার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক পরিমল চন্দ্র সিকদার জানায়,সরকারি অডিট এবং বরাদ্দের অর্থ পেতে যাতে কোন ধরনের সমস্যা না হয় সে কারনেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হাজিরা খাতায় পুর্ন দেখানো হয়। উপবৃত্তির টাকার লোভ দেখিয়ে অন্যান্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভর্তি দেখিয়েই চলছে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম। কেউ পরিদর্শনে এলে দুর দুরান্ত থেকে ভাড়ায় শিক্ষার্থী এনে ক্লাসে বসিয়ে রাখা হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে থাকা আখতারুজ্জামান বাচ্চুকে না পাওয়া গেলেও হাজিরা খাতায় তার সাক্ষর পাওয়া যায়। ১১৫ নং বাদুরতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা জানায়, পশ্চিম বাদুরতলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ‘আবুর স্কুল’ নামেই পরিচিত। এর কারন জানতে চাইলে স্থানীয় ও অন্যান্য শিক্ষকরা বলেন, ঝালকাঠি ইউএনও, উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ শিক্ষা অফিসারদের ম্যানেজ করে বিদ্যালয়টির জুনিয়র শিক্ষক আবু বক্কর হাওলাদার চালাচ্ছে। ফলে শিক্ষা পাঠদান না করেই বেতন ভাতা ভোগ এবং সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থ ভাগবাটোয়ারা করছে। আর এ বিষয়ে পারদর্শী কেবল আবু বক্কর বিধায় তার নেতৃত্বে এবং নামেই বিদ্যালয়টির পরিচিতি পেয়েছে এই উপজেলায়।
প্রতি বছরই বিদ্যালয়টির সংস্থারের কাজ দেখিয়ে এবং আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র ক্রয় করা সহ বিভিন্ন ভাউচারে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করে লুটপাট করে আসছে এই শিক্ষক। উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের সাথে রয়েছে আবু বক্করের বিশেষ লেনদেন। যে কারনে অডিট বা পরিদর্শনে আসা শিক্ষা অফিসারদের বা¯Íব সত্য উপস্থাপন করার সাহস পায়না কেউ।
এলাকার স্থানীয়রা আরও জানায়, বিদ্যালয়ের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না করে কেবল লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করে কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিক বনে গেছে আবু বক্কর হাওলাদার। অথচ স্কুলটি সেই জরাজীর্ন অবস্থাতেই রয়ে গেছে। আর কেউ যদি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করে তখন অফিসাররা মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহন করে নিরব ভুমিকা পালন করে। অভিযোগ কারীদের স্থানীয় থানা পুলিশ দ্বারা হয়রানি করারও উদাহরন রয়েছে, যে কারনে কেউই আর তাদের এহেন অপকর্মের বিষয় মুখ খোলার সাহস করে না। পশ্চিম বাদুরতলা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর জাকির হোসেনের বড় ভাই বলেন, ইউএনও অফিস থেকে টিও এটিও শিক্ষা অফিসাররা অডিটে আাসলে তাদের হাতে নির্ধারিত হারে উৎকোচ এবং প্রচুর উপঢৌকন দেয়া হয়। এর পরেই আবার সব নিশ্চুপ হয়ে যায়। আর পরবর্তীতে অর্থের দাপটে প্রতিবেদন তাদের মনের মত করে পেশ করা হয়।
আর ইউএনও সকাল বিকাল আবু বক্কর হাওলাদারের সাথে চা-পান করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। দহরম মহরম সম্পর্ক থাকায় প্রতিবছর বিদ্যালয়ের সংস্থার করন এবং অন্যান্য বিষয়ের বরাদ্দের লাখ লাখ টাকা প্রতারণা করে লুটপাট করছে। ধর্মীয় শিক্ষক আঃ বাড়ী প্রতিবেদককে জানায়, ১৪২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের স্কুলে, কিন্তু সেই তালিকা ধরে খোঁজ নিয়ে রাজাপুর উপজেলা সহ ঝালকাঠি জেলা শহরের কোথায়ও কারো কোন খোজ মেলেনি। মনগড়া নাম দিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি দেখিয়ে হাজিরা খাতায় উপস্থিতি দেখানো হলেও সপ্তাহব্যাপী সরেজমিন অনুসন্ধানে তাদের সন্ধান মেলেনি। অথচ প্রতিদিন রাত পোহালেই হাজিরা খাতায় তাদের উপস্থিতির বিষয়টি লিপিবদ্ধ থাকে। নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক রেজিষ্টারে প্রধান শিক্ষকসহ ৫ জন শিক্ষক ও ৩ জন শিক্ষিকা রয়েছে। এদের মধ্যে আবু বক্করসহ কয়েকজনের এসএসসি সনদ পত্রও নেই। আরও অভিযোগ রয়েছে এদের মধ্যে জুনিয়র শিক্ষক আবু বক্কর হাং শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র জ্বাল হবার কারনে এতদিনেও কোন পদন্নোতি মেলেনি। অপর দিকে চড়া দামে বিভিন্ন এলাকার অক্ষরজ্ঞানহীন শিক্ষার্থীসহ চাকুরীর জন্য সনদ বানিজ্যের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবেও বিদ্যালয়টির নাম বেশ পরিচিতি পেয়েছে জেলায়। ৮ম শ্রেনী পাশের একটি সনদ বিক্রি হয় অর্ধ লক্ষটাকায়। এমন অভিযোগের বিষয়টিও বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়। সকল অপকর্মের হোতা আবুর স্কুল খ্যাত পশ্চিম বাদুরতলা নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জুনিয়র শিক্ষক আবু বক্কর হাওলাদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি স্কুল চলাকালীন সময়ে ঝালকাঠি আদালতে রয়েছে এবং উপরোক্ত বিষয় অবহিত করে জানতে চাইলে বারবার চা খাওয়ার দাওয়াত দেন।
খোজ নিয়ে আরও জানা যায়, স্বাধীনতার সময় আবু বক্কর তার এলাকার কয়েকজন সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের মাধ্যমে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে তাদের স্থাবর সম্পত্তি জোর পূর্বক দখল করে নেয়। এখানেই শেষ নয়,সম্প্রতি নিজের দুই নিকট আত্মীয়ের জমিও দখল করেছে বলে জানায় নির্ভরযোগ্য সুত্র। তাই এলাকাবাসির ভাষায় শিÿক পদবির চাইতে ‘ভুমিদশ্যু আব’র স্কুল হিসাবে বেশি পরিচিতি পেয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষক আখতারুজ্জামান বাচ্চুর ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া যায়নি। এ বিষয়ে রাজাপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারী স্কুলে পাঠদান না করিয়ে বেতন ভোগ কখনো করতে পারে না। আমরা এ ব্যাপারটা অবগত হয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। যাতে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিÍ হয়। জুনিয়র শিক্ষক আবু বক্করের সাথে ০১৭৬৪৬৭৯৫৩০ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুল বিষয় এড়িয়ে বলেন, তার স্কুলে প্রতি বছর মন্ত্রনালয় থেকে অডিট ও পরিদর্শন করা হয় তাই কোন সমস্যা নেই। এ বিষয়ে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জোহর আলী বলেন,তিনি বিষয়টি অবহিত ছিলেননা তবে অতিদ্রুত তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।
Leave a Reply